ব্যক্তিজীবনে সামাজিক কাঠামো

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান - History & Social Science - NCTB BOOK

ব্যক্তিজীবনে সামাজিক কাঠামো

এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা প্রথমে ২টি কেস স্টাডি পাঠ করব। আমরা কেস স্টাডিতে প্রদত্ত পরিস্থিতি বিশ্লে- ষণ করে ব্যক্তির কাজ বা সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নির্ধারণ করব। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করব এবং সেই পরিস্থিতিতে আমাদের সিদ্ধান্ত কেমন হতো তা নির্ণয় করব। আমরা বিভিন্ন উৎসের সহায়তায় স্থানীয় প্রে- ক্ষাপটে বিভিন্ন সামজিক বিষয় বিশ্লেষণ করব। সামাজিক বিষয়গুলো সামাজিক কাঠামোকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নির্ণয় করব। আমরা যেকোনো প্রেক্ষাপটকে ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার কৌশল- গুলো নির্ধারণ করব। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নির্ধারণ করে সেগুলো সামাজিক কাঠামোর উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে 'দেয়ালিকা' তৈরি করব।

কেস স্টাডি ১

লাবন্য চৌধুরী একজন ফটোগ্রাফার। তাঁর ছবিতে ফুটে ওঠে বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনের গল্প। একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে তার ছবি নির্বাচিত হয়েছে। তিনি ভীষণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সেই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করলেন। প্রথম দিন প্রদর্শনীতে বিভিন্ন দেশের ছবি দেখে তিনি বুঝলেন সবাই তার নিজের দেশের ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছে। শুধু তিনি বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য, দুঃখ, হতাশাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর উপলব্ধি হলো- বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে নিজ দেশের খারাপ চিত্র দেখানো ঠিক হচ্ছে না। তাই সে প্রদর্শনীর কর্তৃপক্ষের কাছ একটি চিঠি লিখে আবেদন করলেন ছবিগুলো তুলে নেওয়ার জন্য। কর্তৃপক্ষ চিঠি পেয়ে তাঁকে জানল তাঁর একটি ছবি ইতোমধ্যে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। সেইসঙ্গে তিনি বেশ ভালো অঙ্কের সম্মানী পাবেন। কিন্তু তিনি যদি ছবিগুলো প্রদর্শনী থেকে তুলে নেন, এই পুরস্কার ও সম্মানী পাবেন না।

কেস স্টাডি ২

ফজলুর রহমান পেশায় একজন চিকিৎসক। বাসায় বৃদ্ধ মায়ের অবস্থা খুব ভালো নয়। মা আজকে ভীষণ অনুরোধ করেছেন তাঁর পাশে কিছুক্ষণ থাকতে। মায়ের কাছে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলেন। এরপর হাসপাতালের জন্য যখন রওনা দেবেন, তখন খেয়াল করলেন মায়ের সারা শরীর কাঁপছে। হঠাৎ জ্বর বেড়ে গেছে এবং প্রেশার কমে গেছে। এমন অবস্থায় মাকে দেখার মতো কেউ নেই। হাসপাতাল থেকে বারবার ফোন আসছে তাই তিনি বাধ্য হয়ে ফোন ধরলেন। ফোনের ওপাশ থেকে জানানো হলো- একজন ইমার্জেন্সি রোগী আসছে। তার জরুরিভিত্তিতে অপারেশন লাগবে। ফজলুর রহমান একটু রেগে গিয়েই বললেন, আমি না থাকলে কি হাসপাতাল চলবে না। তখন তাঁকে জানানো হল, হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে শুধু তিনিই আছেন যিনি এই অপারেশন করতে পারবেন।

লাবন্য চিন্তা করে দেখলেন, এই টাকাটাও ভীষণ প্রয়োজন। তাঁর একটি সংগঠন আছে যারা দরিদ্র মেধাবীদের পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থা করে। গত কয়েক মাসে তাদের সংগঠন প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করতে পারেনি।

- লাবন্য চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন পুরস্কার ও সম্মানীটা নিয়ে নেবেন।

তিনি মায়ের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন। আজকে যা হবার হোক, মাকে একা ফেলে তিনি কোথাও যাবেন না।

দলগত কাজ ১ 

আমরা আগের মতো দলে বসে যাই। এরপর দলে বসে আলোচনা করি- লাবন্য চৌধুরী ও ফজলুর রহমা- নের এই সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে? তাঁরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যথাযথ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন?

এরপর আমরা একটু নিজেদের তাঁদের অবস্থানে চিন্তা করে ভাবি। আমরা ওনাদের অবস্থানে থাকলে কি ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহ হয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম?

আমরা অনেক সময় এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যখন নির্মোহ ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা যদি এটা চর্চা করি, তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। কারণ, নির্মোহ ও ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিলে সেটি ভুল সিদ্ধান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। মানুষ সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার অধিকারী হয়।আমরা অনেক সময় এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যখন নির্মোহ ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা যদি এটা চর্চা করি, তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। কারণ, নির্মোহ ও ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিলে সেটি ভুল সিদ্ধান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। মানুষ সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার অধিকারী হয়।

চলো, এখন তাহলে সমাজের কিছু বিষয় যেমন সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক গতিশীলতা নিয়ে জানি।

অসমতার বিভিন্ন ধরন

সব সমাজই কমবেশি স্তরায়িত। মানবসমাজ বিকাশের প্রাথমিক বা আদিস্তরগুলোতে মানুষের মধ্যে উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ তেমনটি দেখা না গেলেও সমাজ বিকাশের পরবর্তী পর্যায়গুলোতে এই ভেদাভেদ ক্রমে প্রকট হতে থাকে। সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত মানবসমাজে চার ধরনের স্তরবিন্যাস দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো হলো- দাসপ্রথা (Slavery), এস্টেট (Estate), জাতি-বর্ণ (Caste) ও শ্রেণি (Class)। এর মধ্যে প্রথম দুটি ধরন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, জাতি-বর্ণ প্রথার প্রভাব কমছে আর শ্রেণিভিত্তিক স্তরবিন্যাস সমাসাময়িক সমাজে বলবৎ রয়েছে। চলো এখন স্তরবিন্যাসের ধরনগুলো সম্পর্কে জেনে নিই। এর মাধ্যমে আমরা পূর্বের সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল জানতে পারব, সমাজের পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাব এবং সেই সঙ্গে বর্তমান সমাজকাঠামো বুঝতে পারব।

দাসপ্রথা

দাসপ্রথা কৃষি ও সামন্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্য সমাজে এর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। এ প্রথা সমাজকে প্রধানত দাস মালিক এবং দাস এ দুটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। দাস হচ্ছে এমন একজন মানুষ যাকে আইন এবং প্রথা অনুসারে অন্যের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। দাসের কোনো অধিকার ছিল না, সে সম্পূর্ণভাবে অন্যের অধীন। দাসপ্রথা সামাজিক অসমতার একটি চরম রূপ। এক্ষেত্রে সমাজের একটা অংশ সম্পূর্ণরূপে কিংবা অনেকাংশে অধিকার বঞ্চিত থাকে। দাসপ্রথার অস্তিত্ব বিক্ষিপ্তভাবে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নানারূপে প্রচলিত ছিল। তবে দাসপ্রথার দুটি চরম দৃষ্টান্ত রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রাচীন গ্রিক-রোমান সভ্যতায় এবং অন্যটি ১৮ ও ১৯ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলোতে। দাসপ্রথার চরম অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অনেক সমাজ বিশ্লেষক দাসপ্রথাকে একটি 'শ্রমশিল্প ব্যবস্থা' হিসেবে বিবেচনা করেন, যেখানে ক্রীতদাসরা যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়।

এস্টেট

মধ্যযুগে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে প্রথমে 'এস্টেট' বলতে জমিদারি বোঝাত, অর্থাৎ একজন জমিদার বা মালিকের অধীনস্থ জমি। পরে রাশিয়াসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্তব্যবস্থার অধীনে এস্টেট শব্দটি একধরনের সামাজিক স্তর বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগে ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ তিনটি এস্টেটে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে বলা হতো প্রথম এস্টেট, দ্বিতীয় এস্টেট ও তৃতীয় এস্টেট। প্রথম এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল চার্চের নেতা বা যাজকরা। দ্বিতীয় এস্টেট বলা হতো রাজা-রানিসহ অন্যান্য অভিজাতদের। তারা মূলত প্রচুর জমির মালিক ছিলেন যেখানে সাধারণ কৃষকেরা কাজ করতেন এবং সে আয় দিয়ে 'চাকরবাকর' পরিবেষ্টিত হয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করতেন।

আর তৃতীয় এস্টেট বলে গণ্য করা হতো অধিকাংশ সাধারণ জনগণকে, যারা মূলত চার্চ বা অভিজাতদের ভূমি চাষাবাদ করত। তাদেরকে সার্ফও (Serf) বলা হতো। প্রতিটি এস্টেটের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট ছিল এবং এ স্তর বিভক্তি আইনের দ্বারা স্বীকৃত ছিল। জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার মতো জন্মগতভাবে এস্টেটগুলোর সদস্যপদ নির্ধারিত হতো। প্রথম দুটি এস্টেট সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত আর তৃতীয় এস্টেটভুক্তরা শোষিত ও সুযোগ-সুবিধা থেকে ছিল বঞ্চিত।

জাতি-বর্ণ

সামাজিক স্তরবিন্যাসের আরেকটি ধরন হলো জাতি-বর্ণ ব্যবস্থা। ভারতীয় হিন্দু সমাজ মর্যাদার ভিত্তিতে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। জন্মসূত্রেই ব্যক্তি জাতি-বর্ণের সদস্যপদ লাভ করে। এক সময় বিভিন্ন বর্ণের মানুষকে সামাজিক মেলামেশায় বেশ কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হতো। প্রতিটি জাতি-বর্ণের সদস্যকে জন্মসূত্রে নির্ধারিত পেশায় নিয়োজিত থাকতে হতো। ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল যাগযজ্ঞ, পূজার্চনা ও অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করা; ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিল দেশ শাসন ও দেশ রক্ষা করা; বৈশ্যদের কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য

কৃষি ও পশুপালন করা এবং শূদ্রদের কাজ ছিল উপরোক্ত তিন দলের সেবা করা। ভৃত্য, কায়িক শ্রমজীবী ও কৃষকরা ছিলেন শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। ব্রাহ্মণরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। তার চেয়ে কম মর্যাদার অধিকারী ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়দের চেয়ে নিচু মর্যাদার অধিকারী বৈশ্য এবং বৈশ্যদের নিচে অবস্থান শূদ্র বর্ণের মানুষ। সমাজের সবচেয়ে নিচু প্রায় মর্যাদাহীন অবস্থান ছিল অস্পৃশ্য গোষ্ঠীগুলোর।

তবে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, উদারনৈতিক আধুনিক শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি জাতি-বর্ণের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং যেকোনো জাতি-বর্ণের লোক ক্রমে যেকোনো পেশা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে। মুদ্রাবাজার ও ব্যবসা- বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় তথাকথিত নিচু জাতি জমি কিনতে ও জমির মালিক হিসেবে পদমর্যাদা ও ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রসার এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যোগ্যতার ভিত্তিতে সব বর্ণের মানুষই সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় উচ্চপদে আসীন হচ্ছেন। তবে কোনো কোনো পশ্চাৎপদ সমাজে জাতি-বর্ণের প্রভাব এখনো রয়েছে।

সামাজিক শ্রেণি

সামাজিক শ্রেণি হলো সামাজিক স্তরবিন্যাসের আধুনিক প্রকরণ। আঠারোশতকে শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমে ভেঙে যেতে থাকে, নতুন নতুন শহর গড়ে উঠতে থাকে এবং শহরকেন্দ্রিক মানুষও বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে শহরকে কেন্দ্র করে শ্রেণিব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলে আমরা সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি নতুন রূপ দেখতে পাই। একটি শ্রেণিভিত্তিক সমাজে স্তরবিন্যাস কেবল ব্যক্তির জন্ম নয়, তার নিজস্ব অর্জন দিয়েও নির্ধারিত হয়।

শ্রেণিব্যবস্থায় মানুষ মুক্ত, অন্যদিকে পূর্বের তিনটি সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল বদ্ধ। শ্রেণিব্যবস্থায় মানুষ শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের মাধমে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে যেতে পারে। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকে এবং ব্যক্তি তার চেষ্টার মাধ্যমে সমাজের উচ্চ অবস্থান অর্জন করতে পারে। তবে এ-ও মনে রাখতে হবে যে শ্রেণি শুধু ব্যক্তির অর্জন দ্বারা নির্ধারিত নয়, একজন ব্যক্তি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করছে সে পরিবারের সামাজিক অবস্থান অনুসারেও তার শ্রেণি নির্ধারিত হয়।

সামাজিক অসমতা

সমাজে সব মানুষ যে সমান সুবিধা বা মর্যাদা পায় না তা তোমরা জেনেছ। মানুষের নানা স্তরের কথাও জেনেছ। দেখা যাচ্ছে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের কারণে সামাজিক অসমতা ঘটে। যেখানেই সামাজিক স্তরবিন্যাস রয়েছে সেখানেই সামাজিক অসমতা আছে। যদিও মানুষ এমন একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে, যেখানে তাদের ভেতর অসাম্য থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, বিদ্যমান মানব সমাজে কোনো না কোনো ধরনের স্তরবিন্যাস ও অসমতা লক্ষ করা যায়। মানুষে মানুষে সম্পদ ও আয়ের অসাম্যকে আমরা সামাজিক অসমতা বলি। সম্পদ ও আয়ের অসাম্যের কারণে একদল মানুষ উচ্চ মর্যাদা লাভ করে, আরেকদল নিম্ন মর্যাদার অধিকারী হয়।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার সমাজে অসমতার তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। যথা: সম্পদের অসমতা, মর্যাদার অসমতা এবং ক্ষমতার অসমতা। প্রথম কারণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সম্পত্তি অথবা উপার্জন। দ্বিতীয়টির সঙ্গে জীবনযাত্রার মান জড়িত, যার ভিত্তিতে মর্যাদাবান গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। আর তৃতীয়টির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রাজনীতি; যার ফলে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। এভাবেই তাঁর ধারণায় শ্রেণি, মর্যাদা এবং রাজনৈতিক দল সামাজিক স্তরবিন্যাস ও অসমতার তিনটি প্রধান উপাদান হিসেবে বর্তমান সমাজে বিদ্যমান।

তবে আধুনিক কালের এই স্তরগুলো স্থায়ী বা অনড় নয়। এতে পরিবর্তন ঘটে। ব্যক্তি নিজের যোগ্যতায়, পরিশ্রমে এবং বুদ্ধির প্রয়োগে নিজের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারেন। আবার এসবের অভাবে একজনের অবস্থার অবনমনও হতে পারে। একেই বলে সামাজিক গতিশীলতা।

এখন আমরা সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব

সমাজ প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। সামাজিক গতিশীলতার জন্যই মানুষ এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতে পারে। তার ফলে ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদাও পাল্টে যায়। সামাজিক গতিশীলতার ধারণা অনুসারে কখনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায় আবার কখনো কমে যায়। সামাজিক গতিশীলতা সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সামাজিক গতিশীলতা: 

বিদ্যমান সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে একজন ব্যক্তির এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতে পারার সক্ষমতাকে সামাজিক গতিশীলতা বলে। অর্থাৎ ব্যক্তির সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনই হচ্ছে সামাজিক গতিশীলতা।

সামাজিক গতিশীলতার প্রভাবকসমূহ

সামাজিক গতিশীলতা নির্ভর করে সামাজিক ব্যবস্থা কতটুকু বদ্ধ বা মুক্ত তার ওপর। আমরা জেনেছি যে প্রাচীন ও মধ্যযুগে সামাজিক ব্যবস্থা ছিল কঠোর নিয়মে বাঁধা। বিশেষ করে যাদের অবস্থান ছিল সমাজের নিচু স্তরে, তারা ছিল পরাধীন। সমাজ যতই অগ্রসর হয়েছে মানুষের স্বাধীনতা ততই বেড়েছে। পূর্বের যেকোনো সমাজব্যবস্থার তুলনায় বর্তমান বিশ্বে মানুষ অধিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে সব দেশে বা সমাজে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সচলতা একই রকম নয়।

কোনো দেশে আমরা দেখতে পাই সমাজ ব্যক্তির অবস্থান পরিবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। অনেক দেশে আমরা দেখতে পাই, ব্যক্তি তার মর্যাদা ও অবস্থানের উন্নতির জন্য অনেক ধরনের স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। সেখানকার সরকার সকল ধরনের কাঠামোগত বাধা যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। এতে করে মানুষ আশা করতে পারে যে সমাজে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।

সামাজিক গতিশীলতা অর্জন করার পেছনে কতকগুলো প্রভাবক রয়েছে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে অন্যতম। সামাজিক গতিশীলতা অর্জনের জন্য সবার আগে দরকার নিজের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য একজন ব্যক্তির প্রবল ইচ্ছা। এই ইচ্ছাশক্তিই তাকে সমাজের উচ্চ অবস্থানে যাওয়ার জন্য প্রেরণা দেবে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। শিক্ষা হলো সামাজিক গতিশীলতার আরেকটি প্রভাবক। আমাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে না, সমাজে সম্মান ও মর্যাদা অর্জনের মাধ্যমও।

দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা হলো ইতিবাচক প্রভাবক। অন্যদিকে কাঠামোগত কিছু উপাদান সামাজিক গতিশীলতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। যদি সমাজের মধ্যে বৈষম্য বজায় থাকে তবে তা ব্যক্তির সামাজিক গতিশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে। এজন্য ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ ও সম্ভাবনা নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়। এবং তা করার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। আবার রাষ্ট্র যাতে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার জন্য চাপ তৈরি করতে হয়। এটি করে থাকে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলো।

সামাজিক গতিশীলতায় আন্তর্জাতিক সনদসমূহের অবদান

গোড়াতে মনে রাখা ভালো যে আধুনিককালে এই অধিকারের দাবি প্রথম স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লবীরা যেমন সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তেমনি তারা নাগরিক অধিকারের তালিকাও ঘোষণা করেছিলেন। এ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস পেইন (Thomas Paine) মানবাধিকার শব্দ ও ধারণাটি প্রচার করেছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতার পরে ১৭৯১ সালে তাদের সংবিধানে 'বিল অব রাইটস' বা অধিকারের বিল গৃহীত হয়। এটা ব্যক্তির নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। যেমন কথা বলার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা ইত্যাদি।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত হয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (Universal Delecaration of Human Rights)। এটি মাবজাতির এক মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ। এতে মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপ্তি ও অধিকারের গভীরতা সুচিন্তিতভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রতিটি মানুষ যেন তার স্বধীনতা, বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারে এবং তার সকল নাগরিক ও মানবিক অধিকার অবাধে ভোগ করতে পারে, এতে সে কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ঘোষণার প্রথম ধারায় বলা হয়েছে, সব মানব শিশু জন্মায় স্বাধীনভাবে এবং সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে। সকল মানুষেরই রয়েছে যুক্তিবোধ ও বিবেচনাশক্তি এবং তাদের উচিত পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জীবনযাপন। এই ঘোষণায় রয়েছে ৩০টি অনুচ্ছেদ এবং এ থেকে ৬৩টি অধিকারের ধারণা পাওয়া যায়।

শিশু অধিকার সনদ

আমরা অধিকার নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, নানা বাস্তব কারণে অহরহ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। দেশে- দেশে, সমাজে-সমাজে, সংস্কৃতিতে-সংস্কৃতিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে বৈষম্য-বঞ্চনা-শোষণ-নির্যাতন রয়েছে, তার মধ্যে শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। কারণ, শিশুরা না শারীরিক না মানসিক কোনোভাবেই পরিণত নয়। নানাভাবে অপরের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা থাকে বলে তাদের অধিকারের বিষয়ে অন্যের বাড়তি সচেতনতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। যেকোনো ধরনের সংঘাত-দ্বন্দ্বে বা বৈষম্য-বঞ্চনা ও শোষণ-নির্যাতনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা, তাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়। তবে আশার কথা, মানুষ এ বিষয়ে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠেছে। কালক্রমে শিশু অধিকারে বিষয়টি পৃথিবীজুড়ে একটি অভিন্ন ইস্যু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় শিশু অধিকারের ইস্যুটি জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি সনদে রূপান্তরিত হয়।

শিশু অধিকার সনদটি কবে গৃহীত হয়

শিশু অধিকার সনদ বেশি দিনের পুরোনো বিষয় নয়। এই সেদিন ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে এটি গৃহীত হয়। এক বছর পরে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তর্জাতিক আইনের অংশে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানবাধিকার চুক্তি। জাতিসংঘের প্রায় সকল সদস্য দেশ এটি অনুমোদন করেছে। প্রথম যেসব দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।

শিশু অধিকার সনদের বিষয়বস্তু

এই সনদের ৫৪টি ধারার মাধ্যমে এক কথায় শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সকল প্রকার শোষণ-বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার নির্দেশনা রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মা-বাবার সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নাগরিক অধিকার, শোষণ এবং আইনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া শিশুর অধিকারসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব

শিশুর অধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্র ও সরকারের। পাশাপাশি শিশুদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত প্রত্যেকের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মা-বাবা, দাদা-দাদি, বড়ো ভাই ও বোন, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিশুদের কাজে নিয়োজিত সকল ব্যক্তিবর্গ। বলা যায়, সকল বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেরই এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে।

সিডো (CEDAW)

সিডো শব্দটা আজকাল বেশ শোনা যায়। এটি হলো নারীর অধিকার রক্ষার একটি সনদ। ইংরেজিতে পুরো নামটা Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Woman (CEDAW)। বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়- নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ।

দেশে-দেশ, সমাজে-সমাজে, পরিবারে-পরিবারে নারী ও পুরুষের মাঝে বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সিডোর মূল লক্ষ্য। তা ছাড়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান। এ ছাড়া আরও লক্ষ্য হলো সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপন এবং মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।

জাতিসংঘের স্বীকৃতি

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর তরফ থেকে এই সনদে স্বাক্ষর শুরু হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সিডো কার্যকর হয়। ১৯৯৯ সালর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৬৫টি রাষ্ট্র এই সনদ অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেছে।

শিশু অধিকার সনদটি কবে গৃহীত হয়

শিশু অধিকার সনদ বেশি দিনের পুরোনো বিষয় নয়। এই সেদিন ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে এটি গৃহীত হয়। এক বছর পরে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তর্জাতিক আইনের অংশে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানবাধিকার চুক্তি। জাতিসংঘের প্রায় সকল সদস্য দেশ এটি অনুমোদন করেছে। প্রথম যেসব দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।

শিশু অধিকার সনদের বিষয়বস্তু

এই সনদের ৫৪টি ধারার মাধ্যমে এক কথায় শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সকল প্রকার শোষণ-বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার নির্দেশনা রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মা-বাবার সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নাগরিক অধিকার, শোষণ এবং আইনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া শিশুর অধিকারসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব

শিশুর অধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্র ও সরকারের। পাশাপাশি শিশুদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত প্রত্যেকের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মা-বাবা, দাদা-দাদি, বড়ো ভাই ও বোন, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিশুদের কাজে নিয়োজিত সকল ব্যক্তিবর্গ। বলা যায়, সকল বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেরই এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে।

সিডো (CEDAW)

সিডো শব্দটা আজকাল বেশ শোনা যায়। এটি হলো নারীর অধিকার রক্ষার একটি সনদ। ইংরেজিতে পুরো নামটা Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Woman (CEDAW)। বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়- নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ।

দেশে-দেশ, সমাজে-সমাজে, পরিবারে-পরিবারে নারী ও পুরুষের মাঝে বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সিডোর মূল লক্ষ্য। তা ছাড়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান। এ ছাড়া আরও লক্ষ্য হলো সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপন এবং মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।

জাতিসংঘের স্বীকৃতি

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর তরফ থেকে এই সনদে স্বাক্ষর শুরু হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সিডো কার্যকর হয়। ১৯৯৯ সালর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৬৫টি রাষ্ট্র এই সনদ অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেছে .

অধিকার নিয়ে কিছু কথা

অধিকার বলতে সেইগুলোকে বোঝায় যা নিয়ে মানুষ জন্মায়। যেগুলো না থাকলে সে আর মানুষ থাকে না। এগুলোই মানুষকে মানুষ করে তোলে। মানুষ চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা এবং মতামত প্রকাশের যোগ্যতা নিয়েই জন্মায়। কোনো রাষ্ট্র, সরকার বা অন্য কোনো শক্তি তাকে এগুলো দেয় না। তারা বরং সময়-সময় এগুলো হরণ করে নেয়। মানবাধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে।

তাহলে কথা হলো, মানবাধিকার হচ্ছে সেইসব অধিকার, যা নিয়ে মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে এবং যা অর্জিত হলেই সে মানুষ হিসেবে পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। একই সঙ্গে বলা যায়, মানবাধিকার ছাড়া মানুষের পক্ষে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া সম্ভব নয়।

এ অধিকারগুলো তার ন্যায্য পাওনা, কোনো শর্ত সেখানে চলবে না, কমানো-বাড়ানোর অবকাশ নেই। একজন মানুষ যেকোন সমাজে-রাষ্ট্রে-পরিবারে-শ্রেণীতে-লিঙ্গে-সম্প্রদায়ে-ধর্মে-জাতিগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তিনি কতকগুলো অধিকার নিয়েই জন্মান। তাই মানুষের এই অধিকারগুলোকে সর্বজনীন বলা হয়। এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটা বিষয় মনে রাখব-

অধিকার জন্মগত অর্জন

বলতে পারি, একজন মানুষ কিছু অধিকার নিয়েই জন্মায়। তার চিন্তা করার ও তা প্রকাশের অধিকার, যাকে আমরা বাক্ স্বাধীনতাও বলে থাকি, তা মানুষের জন্মগত অধিকার। আবার রাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও কাপড় পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

অধিকার শর্তহীন

শর্ত দিলেই আর সম্পূর্ণ অধিকার পাওয়া যাবে না। অনেক সময় রাষ্ট্র বা সরকার বলে থাকে, 'তুমি কথা বলতে পারো, কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে বলা যাবে না।' অর্থাৎ সব কথা বলা যাবে না। তাতে নাগরিকের স্বাধীনতা খর্ব হলো, অধিকার ক্ষুণ্ণ হল।

অধিকার ও দায়িত্ব

তবে অধিকারের সঙ্গে দায়িত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। অর্থাৎ নাগরিক যেমন অধিকার ভোগ করবে তেমনি তাঁকে কিছু দায়িত্বও পালন করতে হবে। কেননা, সমাজ বহুপথ ও পথের মানুষকে নিয়েই গঠিত হয়। বলা যায় সমাজে আমরা অনেকে মিলে বসবাস করি। ফলে এমন কথা এমনভাবে বলা যাবে না যাতে অন্যের মনে আঘাত লাগে বা তার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটে।

অধিকার ভাগ করা যায় না

বিদ্রোহী' কবিতা লেখার সময় কেউ যদি এসে বলত- কবি নজরুল আপনি এটা অর্ধেক লিখতে পারবেন, পুরো লেখার অধিকার আপনাকে দেওয়া যাবে না। ব্যাপারটা হাস্যকর হতো না!

একটা কলা তুমি বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে খেতে পারো, কিন্তু কলাটা ভাগ করেই খেতে হবে, এভাবে কেউ তোমাকে বাধ্য করতে পারে না। সেটা তোমার বিবেচনা আর বন্ধুত্বের সঙ্গেই সম্পর্কিত বিষয়।

অধিকার আসলে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা

কথা বলার, চলাচলের, মতপ্রকাশের যে অধিকার, সেগুলো তোমাকে স্বাধীনতা দেয়। ভাবনাচিন্তা আর বিচার- বিবেচনা করে তুমি যে কথাটা বলতে চাও, সেটা বলার স্বাধীনতা তুমি ভোগ করো। এই স্বাধীনতা তোমার ক্ষমতাও বাড়ায়।

অধিকার নিরাপত্তার অবলম্বন

সেই ব্যক্তিই স্বাধীন মানুষ, যার মনে ভয় থাকে না, যার জীবন ভয়ে-ডরে কাটে না। যার জীবনটা সব দিক মিলিয়ে নিশ্চিত ও নিরাপদ হয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তিই যথার্থ স্বাধীন। একালে দেশে দেশে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাঁচটি অধিকার ভোগ করে, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা। এগুলো- একজন মানুষের মৌলিক চাহিদা। এ-ও এক ধরনের অধিকার, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জন্য এগুলো নিশ্চিত করা।

দেশের সব নাগরিকের জন্য এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা খুব সহজ কাজও নয়। সুস্থ সবল মানুষকে তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো যাবে না। তার তো খাবার কেনার সামর্থ্য থাকতে হবে। সে খাবারেও কেবল পেট ভরলে হবে না, মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার হতে হবে। আবার তা কেনার সামর্থ্য মানে আয় দরকার। মানে বেকার থাকলে চলবে না। তাই মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করাও রাষ্ট্রের একটা কাজ। দারিদ্র্য অশিক্ষা, বেকারত্ব মানুষের স্বাধীনতা আর অধিকার ভোগের পথে বড়ো বাধা।

অধিকারের সীমা

অনেক সময় দেখা যায়, অত্যন্ত জোরে মাইক বাজিয়ে দাঁতের মাজন বিক্রি করছেন কেউ। কথা হলো দাঁতের মাজনও বিক্রি করতে হবে আবার মানুষের পড়াশোনা, ঘুমেরও ব্যাঘাত করা যাবে না। গাড়ির হর্নও কোনোমাত্রায় বাজানো যাবে তার নিয়ম থাকে। অনেক দেশেই শব্দের মাত্রার সর্বোচ্চ পরিমাপ করে দেওয়া আছে। ঐ মাপের বেশি হলে তা শব্দদূষণ এবং বে-আইনি। তাহলে আমাদের বুঝতে হবে দাঁতের মাজন বিক্রেতার মাইক বাজানোর অধিকারের একটা সীমা আছে। গাড়ির হর্নের ক্ষেত্রেও তা সত্য।

অধিকার ততদূরই ভোগ করা যায়, যতদূর তা অন্যের অধিকার লঙ্ঘন না করছে। রাষ্ট্র, সমাজ, সম্প্রদায়ের ইচ্ছা অনিচ্ছার চেয়েও এখানে বড়ো বিষয় হলো সম-অধিকারের বোধ। অর্থাৎ আমার এবং অন্যের অধিকারের মধ্যে একটা রফা করে চলাই সঠিক কাজ। এ বিবেচনা বোধটা এক অর্থে দায়িত্ববোধ।

দলগত কাজ ২ 

আমরা আগের দলে বসে যাই। এখন আমরা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি সামাজিক বিষয় (ইস্যু): যেমন: সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম ইত্যাদি নির্ধারণ করি। এই সামাজিক বিষয়গুলো আমাদের সামাজিক কাঠামোকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নির্ণয় করি। বিভিন্ন পুস্তক, পত্রিকা, ম্যাগাজিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে ফলাফল উপস্থাপন করি।

বিভিন্ন সামাজিক বিষয় সামাজিক কাঠামোকে কীভাবে প্রভাবিত করে

 

 

 

 

আমরা দলগতভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছি। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, এই তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহ থাকা অনেক প্রয়োজন। তাই এখন আমরা দলে আলোচনা করব অনুসন্ধানের পুরো প্রক্রিয়ায় আমরা কীভাবে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহ ছিলাম।

এরপর যেকোনো প্রেক্ষাপটকে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ কীভাবে করা যায় তার কৌশলগুলো দলে আলোচনা করে নির্ণয় করি।

ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও নির্মোহ থাকার কৌশল

 

 

 

 

 

 

 

দলগত কাজ ৩ 

 

এখন আমরা একটি বৈশ্বিক সামাজিক বিষয় (ইস্যু) যেমন: গৃহহীন মানুষ, যুদ্ধ ইত্যাদি নির্ধারণ করি। এই সামাজিক বিষয় সামাজিক কাঠামোয় কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা দলে আলোচনা করে লিখি। এজন্য আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নেব। এরপর আমরা সব দল মিলে একটি দেয়ালিকা তৈরি করে আমাদের দলগত কাজকে উপস্থাপন করব। দেয়ালিকায় আমরা বিভিন্ন গল্প, ঘটনা, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখে উপস্থাপন করতে পারি।

Content added || updated By
Promotion